মেয়েদের নিয়ে কত স্বপ্নই না বাবা মায়ের। বড় হয়ে একদিন মা বাবার স্বপ্নপূরণ করবে তারা। স্বপ্ন পূরণে অনেকে গ্রাম, গঞ্জ থেকে শহরে পারি জমায় ক্যারিয়ার তথা চাকরির উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে, মধ্য পরিবার, গরীব পরিবারের সংখ্যা কম নয়। তবে বেশিরভাগই শহরে পারি জমায় ধনীর দুলালীরা। কেউবা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তবে, সীমিত সুযোগ থাকায়, অনেককে ভর্তি হতে হয়, প্রত্যন্ত গ্রামেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনের কষ্ট চেপে তাই তারা আবার চেষ্টা করে প্রথম বর্ষ শেষ করে, দ্বিতীয় বর্ষে শহর বা ঢাকায় স্থানাস্তরিত হতে। কিন্তু সবার কি স্বপ্ন পূরণ হয়। কত বাঁধা, কত বিপদ, কত দুঃখ আর কষ্ট করে বড় হতে হয় মেয়েদের। অনেকে আবার ঝড়ে পড়ে শহরের নানা বৈচিত্রময়, অজানা আর অকল্পিনীয় গল্পের মতো করে। তার জ্বলন্ত উদাহরণ ইডেনের মেয়েদের বর্তমান হালচাল। আবার অনেকে আছেন যারা ইডেনে থাকেন না থাকেন কোন মেস, হোস্টেল বা বাসা বাড়ির সাবলেটে। তারই একটি নমুনা। ছন্দ নামে কিছুটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হলো।
মেয়েটির নাম মণি। বাড়ি দরলাম কোন এক জেলা···। বাবা মায়ের বড় মেয়ে। ছোট ভাই আছে, চোখে কম দেখে। তাই ভাইটিকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই মায়ের। আছে ছোট্ট আরেক মেয়ে তবে তার হাতে সমস্যা। অনেকটা জন্ম থেকেই অবশ ছোট্ট মেয়েটি। তাই বাবা মায়ের যেন সব স্বপ্ন মণিকে নিয়ে। মণিকে তাই গ্রামের ছোয়া না লাগিয়ে জেলা শহরে নানির বাড়ি থেকে পড়াশোনা করালো বাবা মা। ভাল ফল করলো এসএসসিতে। তার ধারাবাহিকতা রইলো এইচএসসিতেও। এবার উচ্চ শিক্ষার পালা। মেয়ে ভর্তি হবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে নেই যথার্থ গাইডলাইন। কে দেখাবে হাল। নিজের চেষ্টাই দুবার চেষ্টা করলো মেয়েটি ঢাবি, জাহাঙ্গীর নগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে ঠেকিয়ে রাখলো অগাধ প্রতিযোগিতা। পিছনে পড়লো অনেকটা। মনের দুঃখ চেপেই রইল মেয়েটির। তবে চান্স পেলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুটা আশা নিয়ে প্রথম বর্ষ শেষ করলো সে। দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে অনেকটা আশা নিয়ে চেষ্টা করলো ঢাকায় আসার। তবে ঢাকায় থাকার খরচ পাবে কোথায় বাবা মা তো বিয়ে দিয়ে বিদায় করলেই পারে। ঢাকা অনেক বড় ভাই আত্নীয় স্বজনের কাছ থেকে কিছু একটা করার চিন্তা করলো। অনেকে দেখালো পার্ট টাইম বা কোন ছোট খাট চাকরি করার কিছু সুযোগ। ভাগ্যের কারণে চেহারা ভাল থাকায় শহরের চাকরি ভাগ্যে জুটলো মেয়েটির। অনেক আশা নিয়ে পাড়ি দিলো ঢাকায়। আসলো ইডেন কলেজে ভর্তি হতে।
তবে মেয়েটি থাকবে কোথায়। টাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা আবাসন। কথায় বলে--- বাবা তুমি এক পেট খেয়ে যাও তাও ভাল তবে থাকবে দিতে পারবো না। অনেকটাই সত্যি ঢাকা শহরে। এক বড় ভাইকে বলে একটা হোস্টেল ম্যানেজ করা গেল। স্থান ফার্মগেট, তেঁজকুণিপাড়া। অনেক ম্যাসই গড়ে উঠেছে এখানে। তবে মেয়েদের মেসের সংখ্যা নেহায়েতই কম। আর যেগুলো আছে গাদা গাদি করে থাকতে হয় মেয়েদের। অনেকে আবার থাকে নিচে ও উপরে করে। ঢাকায় এক ফ্লাটে দুতলা করে থাকে এমন আবাসন আমার মনে হয় মেয়েদেরই কপালে। তবে পড়বে না কেন। কেউ তো মেয়েদের থাকার জন্য বাসা দিতে চায় না। অনেকে কোন মতে একটি ফ্লাট ভাড়া নিয়ে তা আবার মেস বানিয়ে ডবল হারে ব্যবসা করছে। এ ব্যবাসা থেকে আবার জীবিকা নির্বাহ করছে অনেকে। তাই মেয়েদের উপর তো চাপ পড়বেই। এসব মেসের বা হোস্টেলের সমস্যার কথা কি বলবো। খেলেও না খেলেও টাকা প্রতি মাসে স্থায়ী তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার দিতেই হবে। নেই ভাল বাথরুম, পানি সমস্যা, গ্যাস নেই, বিদুøৎ তো থাকেই না। খাবারের মান একতরফা। যা দিবে তাই খেতে হবে। আর কিছু নিজে থেকে কিনতে গেলে অনেক দাম। এতো গেলো হোস্টেলের অবস্থা। চাকুরি করতে যেয়ে, গাড়ি দিয়ে আসা এবং যাওয়ায় কত দুষ্ট লোকের খপ্পরে পড়তে হয় তার। অনেক সময় গাড়িতে না উঠতে পেরে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ আসে ৬০ টাকা দিয়ে। আবার শাহবাগ থেকে ফার্মগেট যায় ৮০ টাকা দিয়ে। তারপর চাকরি করতে যেয়ে কলিকদের সাথে আচার ব্যবহার চাল চলন, কথা বার্তায় কেমন যেন সবাই একটু খাটাতে চায়। গ্রামের বলে সরলতার সুযোগ নেই। একটু ভুল হলেও ধমক। অনেকের আবার দূরের আত্নীয় ঢাকায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। এলাকা থেকে নতুন কেউ ঢাকায় এসেছে শোনে আৎকে উঠে তারা। তুই ঢাকায় আসলি আর জানালি না। তারাও নানা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। এদিক সেদিক বুদ্ধি দেয়। কিছুটা ভাল কিছুটা মন্দ। এভাবেই চলে দিন কাল। তবু থমে যায়নি দিন। বড় হতে হবে স্বপ্ন অনেক বুকে।
মেসের সহপাঠীদের কেউ একেক জন একেক জেলার। একেক ধরনের মন মানসিকতা। তারপরও অসহায় হয়ে চলতে হয় মেয়েদের সাথে। এদের কেউ আবার প্রেম করে বয় ফ্রেন্ড আছে। কেউ আবার ঢাকায় এসে লুকিয়ে বিয়ে করে বাবা মাকি না জানিয়ে। এমনই একজন জুট ছদ্দ নাম লিটন, নদী। তার লুকিয়েই বিয়ে করেছে। ছেলে তিতুমীরে তৃতীয় বর্ষে, মেয়ে ইডেনে তৃতীয় বর্ষে। ভালই জমে উঠছে লুকিয়ে বিয়ে করার মজা। মাঝে মাঝে ঝগড়া হয়। অনেকে বলে এদের সংসারটা হয়তো ভেঙ্গেই যাবে। তবে ভাঙ্গা আর গড়ার মধ্যেই চলছে দিনকাল।
এমনই এক জুটির কবলে পড়ে সদ্য ৩ মাস হলো নানা সমস্যায় পড়ে বড় হওয়া গ্রামের অসহায় মেয়ে মণি। জুটিদের হাতে নেয় টাকা, তাই নানা রকম ফন্দি আটে টাকা কামানোর। যেমন করেই হোক প্রেমের বিয়ে বিজয়ী হতে হবে। তাই হাতে নেই নানা ধান্দা। অসহায় মণি বুঝতে পারেনি তাদের ফন্দি। প্রায় হোস্টেলে নদীর কাছে আসে লিটন। তবে তার সাথে আসে মামা নামের কেউ। মামা শহরের বড় ব্যবসায়ী। বসবাস লিটনের সাথে একটি সাবলেট বাসায়। একসাথে থাকার কারণেই প্রায়ই মামা আসে লিটনের সাথে। তবে একদিন হোস্টেলে এসে নদীর বান্ধবী গ্রামের মণির সাথে পরিচয় হয়। মনের অজান্তেই মণিকে ভাল লেগে যায় মামার। আটে নানা ফন্দি। তারপর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেখা করতে আসে মামা। মামা বলে জানো আমি কেন আসি প্রতিদিন। কেবল মণিকে দেখতে। মণিকে একদিন সরাসরি অফার দেয় মামা। আমি তোকে বিয়ে করতে চায়। তোর সাথে প্রেম করতে চায়। মণির সব সময় না। গ্রামের গরীর ঘরের মেয়ে বাবা মায়েই ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হবে না।
তবে মামার ফন্দি মণিকে আমার চাইই চাই। নদী আর লিটনকে ম্যানেজ করে সে। যত টাকাই লাগুক না। একদিন নদী বলে মণি চল তোকে আজ এক জায়গায় নিয়ে যাবো। কোথায় বলা যাবে না। দেখবিইতো। মণি বলে না বল কোথায়। নদী বলে লিটনের বাসায়। তো লিটন নদীর লুকিয়ে বিয়ে করা জামাই যেহেতু সেখানে যাওয়াতো যেতেই পারে। এদিকে, দুই তিন মাসে হোস্টেলে যাতায়াতে লিটনকে দুলোভাই আর মামার সাথে বেশ সখ্য গড়ে উঠে মণির। তাই নদীর প্রস্তাবটা ফেলতে পারেনা মণি। তবে, মামা কথা মনে নেই মণির। লিটনের বাসা মহাখালিতে তিুতুমীর কলেজের পিছনের একটা সাবলেটে। সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেলো দু’জন। বিকেলের নাস্তা করে অনেক গল্পের এক পর্যায়ে মামা বলে বসলো চল আজ আমরা ব্যতিক্রম ধরনের একটা কিছু করি। এজন্য ড্রিংস মানে বেয়ার খাওয়া যেতে পারে। মণি জানে বেয়ার কি। কিছুই কৌতুহল তো থাকতেই পারে। তাই ৪ জনে রেস্টুরেন্ট থেকে বড় এক বোতল বেয়ার নিলো। সব নিয়ে আসলো বাসায়। ২ মেয়েকে খাওয়ালো ৩ পিক করে। আর তাতে তারা হয়ে গেল সেন্সলেস। এগুলো খাবার পর থেকে কিছুই বলতে পারেনি নদী ও মণি। তবে লিটন ও মামা খায় একটা করে। তাদের কোন সমস্যা হয়নি। তারপর মেয়ে দুটো সারারাত আর রাত পার হয়ে সকাল পর্যন্ত অচেতন ছিল।
এদিকে, কোন ভাই, মণিকে খোঁজ নেয় হোস্টেলে। মেসের কেউ বলতে পারে না মণি আর নদী কোথায়। হোস্টেল কর্তৃপক্ষও জানে না মেয়েরা কোথায়। অনেক খোঁজাখুজির পর সকালে নদী আসলো হোস্টেলে বলে রাতে ছিলাম আত্মীয়ের বাসায়। এদিকে মণি যায় সকাল ৯টায় অফিস থাকলেও সাড়ে ১০টায়। অফিসেও ধরা এতো দেরি হলো কেন। হোস্টেলের চাপ। এরইমধ্যে বাসায় জানাজানি হয়ে যায় মণি হোস্টেলে রাতে ছিল না। কথা শুনে সেদিনই অভিভাবক আসে ঢাকায়। সব শুনে বলে আমার মেয়ে মণির উচ্চ শিক্ষার দরকার নেই। আমি আমার মেয়েকে হারাতে চাই না। আমার জেলাতেই থাকতে চাই। দরকার নাই উচ্চ শিক্ষার। তারপর ইডেনে আর ভর্তি হওয়া হয়ে উঠলো না মণির। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে চলে গেল গ্রামে। সেখানেই পড়াশোনা শুরু। হয়তো একটা বিয়ে দিয়ে বাকী কাজটা সারতে চায় বাবা মা। কি আর করবে মণি। জীবনে না বুঝে ভুল করেছে। সেজন্য বাবা মায়ের কথাতো মানতেই হবে। তবে, মণি আর বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ ব্যর্থ করতে দায়ী কে। এ সমাজ। নাকী স্বার্থপর চরিত্রহীনা লিটন আর মামা টাইপের কিছু ব্যক্তি। এ প্রশ্নই আমাদের মতো সচেতন মহলের। এরকম অনেক স্বপ্ন ধুলিস্বাৎ হয়ে যায় মণির মতো। ঢাকা শহরের আধুনিক ছোঁয়া আর অসৎ চরিত্রের লোকের কাছে ধরা পড়ে নিজের স্বতিত্ব আর মান মর্যাদা হারিয়ে ফেলছে আজকের উঠতি বয়সের তরুণ তরুণীরা।
আশা করি আমি ও আমাদের এসব অপ্রকাশিত দুঃখ ও কষ্টগুলো দূর করতে মেয়েদের প্রয়োজনীয় হোস্টেল তৈরী, মেয়ের নিরাপত্তা বাড়ানো, মেয়েদের বাজেট বাড়ানো, আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা হোস্টেলগুলোর জন্য আইন তৈরীসহ নানা সুবিধা বাড়াতে সরকার, প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবে। দূর হবে আমি ও আমাদের দুঃখ এ আশা একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে করতেই পারি।